(‘ঐতিহ্যের বুনন’, শিল্পী: কনকচাঁপা চাকমা)
গ্যালারির দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল হাতে বোনা কাপড়ের বিভিন্ন রঙের সুতা, চরকা; একটু দূরের দেয়ালে বড়-ছোট বিভিন্ন আকারের পেইন্টিং। প্রদর্শনটি একটু ব্যতিক্রম—শুধু দেয়ালে ঝোলানো ছবি নিয়েই এ প্রদর্শনী নয়, এখানে আছে তিন প্রজন্মের শিল্পীর তিন ধরনের কাজ। শরতমালা চাকমা, কনকচাঁপা চাকমা ও শিরোপা পূর্ণা—তিনজন হলেন প্রদর্শনীর শিল্পী। তাঁদের সম্পর্কটি আবার পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ।
রাঙামাটি জেলার শুভলং বাজারের খুব কাছেই মাচ্ছরি গ্রাম। এখানে ১৯৩২ সালে জন্মেছেন শরতমালা চাকমা। ছোটবেলা থেকেই তিনি দেখে আসছেন তাঁদের বাড়িতে বোনা হয় তাঁতের কাপড়। নানা চড়াই-উতরাইয়ের মধ্যেও থেমে থাকেনি এই কাপড় বোনার কাজ। একসময় বিজয় চন্দ্র চাকমার সঙ্গে বিয়ে হয় শরতমালার। শরতমালা ও বিজয় চন্দ্রের তৃতীয় সন্তান শিল্পী কনকচাঁপা চাকমা।
পাঠক, আমরা হয়তো এখন বলতে পারি, শরতমালার পরিবারে সুতা আর রঙের আনাগোনায় বেড়ে উঠেছেন কনকচাঁপা চাকমা। আর রং-রেখার প্রতি কনকচাঁপার যে টান, এটাও কি সেই সূত্র ধরে?
শরতমালা চাকমার শিল্পকলাশিরোপা পূর্ণা—কনকচাঁপা চাকমার মেয়ে। শৈশব থেকে বেড়ে উঠেছেন মা-বাবার ছবি আঁকা দেখতে দেখতে। একসময় শুরু করেন স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ। এ তো গেল তিন প্রজন্মের শিল্পীদের পরিচয়। এবার কথা হোক তাঁদের শিল্পকলা নিয়ে
(শরতমালা চাকমার শিল্পকলা)
শরতমালা চাকমার শিল্পকলা প্রদর্শনীর শিল্পকর্মগুলোর মধ্যে শরতমালা ও শিরোপা পূর্ণার কাজ আমরা দেখছি একদম নতুনভাবে। ১৪টি ফ্রেমে সুতায় বোনা শেষ হয়নি, এমন অবস্থা রেখে প্রদর্শনীতে হাজির হয়েছে শরতমালার কাজগুলো। কাজগুলোর বিশেষত্ব হলো সুতার রঙে বৈচিত্র্য তৈরি করা। চাকমা পরিবারে বোনা কারুশিল্প আমরা সাধারণত যে রঙে তৈরি করতে দেখি, এ কাজগুলো তার চেয়ে ভিন্ন রকম। এতে দেখা যায়, উজ্জ্বল লাল রঙের সঙ্গে সোনালি ও কালো রঙের সমন্বয় করে কাপড় তৈরির কৌশল। নিজের কাজে এ রকম অন্য অনেক রঙের সমাবেশ ঘটিয়েছেন শরতমালা, যা আমরা সাধারণত দেখি না।
প্রদর্শনীর কনিষ্ঠ শিল্পী শিরোপা পূর্ণা। প্রদর্শনীতে তিনি রেখেছেন তাঁর চারটি আলোকচিত্রসহ বেশ কটি জলরং ও চারকোলের কাজ। সঙ্গে প্রদর্শন করছেন ১০ মিনিটের ভিডিও চিত্র ‘বার্ডস ইন আ কেইজ’। ভিডিও চিত্রে মানুষ ও পাখির মধ্যে প্রাধান্য পেয়েছে স্বাধীনতার চিন্তা। মানুষের মনে মুক্তির যে আকাঙ্ক্ষা থাকে, সেটি ভিডিও চিত্রে উপস্থিত ছোট্ট এক গৃহশ্রমিক মেয়ের মধ্যেও আছে। দৈনন্দিন নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে বেড়ে ওঠে মেয়েটি, পার করে সময়; তবে তাঁর চোখে মুক্তির আশা। শিরোপা পূর্ণা শিল্পের সব শাখায় (চলচ্চিত্র, চিত্রকলা, আলোকচিত্র) সমান দক্ষতা দেখিয়েছেন। তাঁর কাজে ফুটে উঠেছে মানবিক বোধের উপস্থাপন।
কনকচাঁপা চাকমা এ প্রদর্শনীর ক্যানভাসে ৩৬টি কাজের বাইরে কাগজের ওপর কালো রেখার ড্রয়িং রেখেছেন সাতটি। এবারের প্রদর্শনীতে মায়ের হাতে বোনা তাঁতের পরিবেশকে ছবির বিষয় করেছেন তিনি। তিনটি বড়মাপের ক্যানভাসের একটিতে দেখিয়েছেন কাপড় বুনন মুহূর্তের ব্যস্ততাকে। ছবিটির শিরোনাম ‘স্পিনিং লাইফ’—বাংলায় ‘জীবন বোনা’। এ ছবিতে দেখা যায়, চরকায় সুতা ভাঁজের কাজে ব্যস্ত চাকমা নারীরা। ছবির জমিনের লাল রঙের আভা এসে আলোকিত করছে নারীমুখ। অন্যদিকে, ছোট ক্যানভাসগুলোতে পাহাড়ি নারীর অবয়ব, কোনো ক্যানভাসে শুধু পাহাড়ি নারীর পোশাক সাজসজ্জার বিশেষ উপস্থাপন। রঙের প্রলেপ, বুনটের উপস্থাপন, রেখার গতিতে সিদ্ধহস্ত কনকচাঁপা। এবারের প্রদর্শনীতে তাঁর কাজগুলো বিষয় ও উপস্থাপনার দিক থেকে ব্যতিক্রমী—বিশেষত মা ও মেয়ের শিল্পকর্মের বিষয় এক হয়ে বিশেষভাবে অর্থপূর্ণ হয়েছে।
অ্যাথেনা গ্যালারি অব ফাইন আর্টসে ১৭ অক্টোবর শুরু হওয়া এ প্রদর্শনী শেষ হবে ৭ নভেম্বর।
info:http://www.prothom-alo.com/
No comments:
Post a Comment