আজ থেকে একশ কিংবা দুইশ বছর আগে পৃথিবীতে
এমন অনেক কিছুই ছিল যা এখন আর নেই। আবার এখন যা আছে তা পরবর্তী একশ কিংবা
দুইশ বছর পর থাকবে না। এটাই পৃথিবীর ভাঙ্গাগড়ার খেলা। মানব সভ্যতার ইতিহাস
নিয়ে নাড়াচাড়া করলে এমন অনেক রহস্যময় বিষয় বেরিয়ে আসে। যেমন – একসময়
পৃথিবীর বুকে এমন কিছু শহর ছিল। যেখানে লোকজন বসবাস করতো। কিন্তু কালের
বিবর্তনে সেই শহরগুলোই এখন মাটির নিচে চাপা পড়ে আছে। কোনো এক সময় মানুষের
অজান্তেই আবিষ্কৃত হয়েছে মাটির নিচের শহরগুলো এবং তারপর বিভিন্ন তথ্য
উপাত্ত থেকে মানুষ বের করে সেই শহরটি সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য। আসুন বিশ্বের
এরকম কিছু শহর সম্পর্কে জেনে নিই।
মাচুপিচু
ইনকা সভ্যতা হচ্ছে পৃথিবীর ইতিহাসে সমৃদ্ধ ও
বিখ্যাত সভ্যতার মধ্যে অন্যতম। এটি পেরুর একটি সভ্যতা। এই ইনকা সভ্যতার
মানুষদের বসবাস ছিল এই মাচুপিচু শহরে। সে অনেক দিন আগের কথা। ১৪৫০ সালে
ইনকারা মাচুপিচু শহরটি নির্মাণ করে। এর ঠিক একশ বছর পরই স্প্যানিশদের
আক্রমণে ইনকাদের নির্মিত সব শহরই ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু সেদিন স্প্যানিশরা
ইনকাদের আর সকল শহরের সন্ধান পেলেও এই শহরটির সন্ধান পায় নি। যার কারণে
মাচুপিচু শহরটি ধ্বংসের হাত থেকে বেঁচে যায়। কিন্তু মানুষজন না থাকার কারণে
এক সময় শহরটি পরিত্যাক্ত হয়ে যায়। দীর্ঘ চারশ বছর পর ১৯১১ সালে হাইরাম
বিংহাম নামের এক মার্কিন নাগরিক এই শহরটি আবিষ্কার করেন। মাচুপিচুকে
সূর্যনগরী নামেও ডাকা হয়। এই মাচুপিচুর অনেক রহস্য উদঘাটন করা সম্ভব হলেও
বেশিরভাগ রহস্যেরই কোনো কূলকিনারা হয় নি।
মাচু পিচুর অদ্ভুত স্থাপত্যশৈলীর সবগুলোই
পাথরের তৈরি মজবুত কাঠামোর ওপর দাঁড়ানো। এত ওপরে এমন মজবুত অবকাঠামো কীভাবে
নিপুণভাবে নির্মিত হলো সেই উত্তর আধুনিক বিজ্ঞান আজ পর্যন্ত দিতে পারেনি।
পাহাড়ের এক পাশ চূড়া থেকে একেবারে খাড়াভাবে ৬০০ মিটার নিচে উরুবাম্বা নদীর
পাদদেশে গিয়ে মিশেছে। অন্যদিকে হুয়ানা পিচু নামের আরেকটি পর্বত খাড়া উঠে
গেছে আরও কয়েক হাজার ফুট উঁচুতে। সুতরাং দুই দিক দিয়েই শহরটি
প্রাকৃতিকভাবেই বেশ নিরাপদ ছিল। এ কারণে শহরটিকে ইনকাদের প্রাচীন দুর্গনগরী
নামেও ডাকা হয়। শহরটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২,৪০০ মিটার (৭,৮৭৫ ফুট)
উঁচুতে অবস্থিত। অর্থাৎ আমাদের দেশের সর্বোচ্চ চূড়া তাজিনডং (১২৩১ মিটার)
এর প্রায় দ্বিগুণ উচ্চতায় অবস্থিত এই শহরটি! এত উঁচুতে কীভাবে তারা একটা
আস্ত শহর তৈরি করে ফেলল সেটাই সবচেয়ে বড় রহস্য। তাও আবার অনেক অনেক বছর
আগে।
জেরিকো
ইনকা সভ্যতা যেমন পৃথিবীর সমৃদ্ধ ও বিখ্যাত
সভ্যতা তেমনি জেরিকো হচ্ছে পৃথিবীর প্রাচীনতম শহর। ৭০০ বছরেরও বেশি সময়ের
পুরনো এই শহরটি আবিষ্কার করেন ইংরেজ প্রত্নতত্ত্ববিদ ড. ক্যাথলিন টেল।
মাটির নিচের এই জেরিকো শহরটি প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত ছিল। মৃত সাগরের
উত্তরে এক মরুদ্যানে এই শহরের অবস্থান ছিল। তবে শহরটি আবিষ্কৃত হওয়ার হওয়ার
যতটুকু জানা গেছে তাতে মনে হয়েছে এই শহরে দুই থেকে তিন হাজার লোকের বসবাস
ছিল। খুব ছোট এই শহরটি লম্বায় ছিল ২৮৪ গজ এবং চওড়ায় ছিল ১৭৫ গজ। জেরিকো শহর
থেকে আরও জানা যায় সে সময় মাটির ইট ও চুন ব্যবহার করে ঘর তৈরি করা হতো।
ধারণা করা হয় জেরিকোতে যারা বসবাস করতেন তাদের পূর্বপুরুষ যাযাবর ছিলেন।
যাযাবর জীবন ছেড়ে তারা জেরিকোতে স্থায়ী বসবাস গড়ে তোলে।
পেত্রা
জর্ডানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পেত্রা
শহরটির অবস্থান। ১৮১২ সালে সর্বপ্রথম এক সুই পরিব্রাজকের মাধ্যমে এই শহরটি
আবিষ্কৃত হয়। পাহাড়ের মধ্যে পাথর কেটে বানানো হয়েছিল পেত্রা শহরটি। আর
পেত্রা অর্থও পাথর। ইতিহাসবিদের মতানুসারে খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ থেকে
খ্রিস্টপূর্ব ২০০ পর্যন্ত নাবাতাইন রাজ্যের রাজধানী ছিল এই পেত্রা শহরটি।
পেত্রা শহরটি ছিল অত্যন্ত সুরক্ষিত এবং এখানকার মানুষ অর্থনৈতিকভাবে ছিলেন
বেশ সমৃদ্ধশালী। এই শহরটি মূলত একটি গুহার মধ্যে তৈরি। কোনো কোনো স্থানে
এটি মাত্র ১২ ফুট চওড়া। শহরটির চারপাশে ছিল উঁচু সব পাহাড় এবং পাহাড়গুলোতে
ছিল অফুরন্ত ঝরনাধারা। পশ্চিমের গাজা, উত্তরের বসরা ও দামাস্কাস, লোহিত
সাগরের পাশের আকুয়াবা ও লিউস এবং মরুভূমির ওপর দিয়ে পারস্য উপসাগরে যাওয়ার
প্রধান সব বাণিজ্যিক পথগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করত পেত্রা। রোমান শাসনের সময়
সমুদ্রকেন্দ্রিক বাণিজ্য পুরোদমে শুরু হলে পেত্রা দ্রুত ধ্বংস হতে থাকে।
১০৬ এডিতে রোমানরা এটিকে দখল করে তাদের ‘আরব পেত্রাইয়া’ প্রদেশের অংশীভূত
করে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতকে বাণিজ্যিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ শহরটির
দখল নেয় পামিরা। তখন থেকেই এর গুরুত্ব কমতে থাকে। সপ্তম শতকে মুসলমানরা ও
দ্বাদশ শতকে ক্রুসেডাররা পেত্রার দখল নেয়। মূলত এরপর থেকেই পেত্রা ধ্বংস
হতে শুরু করে। এ ছাড়া ৩৬৩ সালে ভয়াবহ এক ভূমিকম্পে এ শহরের বিপুল পরিমাণ
ক্ষতিসাধিত হয়।
ট্রয়
এটি একটি কিংবদন্তি শহর হিসেবে পরিচিত। এই
শহরটিকে কেন্দ্র করেই বিখ্যাত ট্রয়ের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। এই যুদ্ধের
কারণেই এই শহরটি ধ্বংস হয়ে যায়। প্রাচীন গ্রিসের অনেক মহাকাব্যেই এই শহর ও
ট্রয় যুদ্ধ সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। সেসব মহাকাব্য থেকে জানা যায়
ইতিহাসখ্যাত সুন্দরী হেলেনকে নিয়ে সংঘটিত হয় এই ট্রয় যুদ্ধ। রোমান সম্রাট
অগাস্টাসের রাজত্বকালে প্রাচীন ট্রয় নগরীর ধ্বংসস্তূপের ওপর ইলিয়াম নামে
নতুন একটি শহর নির্মিত হয়। কনস্টান্টিনোপল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত
ইলিয়াম বিকশিত হয়েছে, কিন্তু বাইজান্টাইন রাজত্বের সময় ধীরে ধীরে এর পতন
হতে থাকে।
পরবর্তীতে ১৮৭০ সালে জার্মান প্রত্নতত্ত্ববিদ হাইনরিশ শ্লিমান এই এলাকায় খননকাজ শুরু করেন এবং একের পর এক শহরের সন্ধান মিলতে থাকে।
আটলান্টিস
পৃথিবীর রহস্যময় জায়গাগুলোর মধ্যে
আটলান্টিস হচ্ছে সেরা রহস্যময় জায়গা। পৃথিবীর বুক থেকে যতগুলো শহর হারিয়ে
গিয়েছে তার মধ্যে এটি একটি বিখ্যাত একটি শহর। এটি ছিল একটি সমৃদ্ধশালী ও
উন্নত একটি শহর। জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিল্প-বাণিজ্য, সবুজ-শ্যামলের পাশাপাশি এই
শহরের খনিগুলোও সোনা, রুপা ও তামার আকরিকে ভরপুর ছিল। এই শহরের প্রধান
আকর্ষণ ছিল এর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত রাজপ্রাসাদ। এই রাজপ্রাসাদটি একটি
টিলার উপর অবস্থিত ছিল। সাজানো-গুছানো জলপথ ও স্থলপথ দ্বারা শহরটি বেষ্টিত
ছিল। এই শহরের রাজার সুশাসনের ফলে শহরের বাসিন্দারা সবাই সুখে-শান্তিতে বাস
করতেন। কিন্তু তাদের সুখ প্রকৃতির সহ্য হয় নি। ভয়ংকর ভূমিকম্পের সাথে সাথে
বিস্ফোরিত হতে শরু করল আগ্নেয়গিরি। মহাপ্রলয় শুরু হলো সমুদ্রে। সমুদ্রের
দানবীয় থাবায় বিলীন হয়ে গেল সাজানো গুছানো শহরটি। তবে এটা কতটুকু সত্যি তা
নিয়ে মতভেদ রয়েছে।
প্লেটোর বর্ণনা মতে, বর্তমান জিব্রাল্টার
প্রণালীর কাছেই অসম্ভব উন্নত, আধুনিক ও সুশৃঙ্খল এক দ্বীপ ছিল আটলান্টিস।
অদ্ভুত সব আবিষ্কার, সুন্দর সমাজব্যবস্থা ও আধুনিক জীবনধারা সবই ছিল
আটলান্টিসবাসীর কাছে। প্লেটোই বর্ণনা দিয়েছেন, প্রায় ১২ হাজার বছর আগে, শেষ
বরফ যুগের আগে ভয়াবহ এক প্রাকৃতিক দুর্যোগে হারিয়ে যায় আটলান্টিস।
পম্পেই
ছোট এই শহরটি ইতালির কাম্পানিয়া অঞ্চলের
আধুনিক নাপোলির কাছে পম্পেই ইউনিয়নে অবস্থিত ছিল। ৬০ ফুট উঁচু ছাই ও
ঝামাপাথরের নিচে চাপা পড়ে এই শহরটি ধ্বংস হয়ে যায়। এর কারণ ছিল ৭৯
খ্রিস্টাব্দে ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরির দুই দিন ব্যাপী অগ্নুৎপাত। অবশ্য এর
আগে ৬২ খ্রিস্টাব্দে ভয়াবহ এক ভূমিকম্প আঘাত হেনেছিল পম্পেই শহরটির উপর।
ভূমিকম্পের পর পুণরায় শহরটিকে নির্মাণ করা হয়। ঠিক এর ১৭ বছর পরই অগ্নুৎপাত
আঘাত হানে শহরটির উপর। প্রাচুর্যে ভরা পম্পেই নগরী লাভার নিচে পড়ে ধ্বংস
হয়ে যায়। ১৫৯৯ সালের দিকে পম্পেইয়ের একটি অংশ মাটি থেকে বেরিয়ে আসে। তারপর
পুনঃখননের ফলে বেরিয়ে আসে হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস। তবে এটি সম্পূর্ণরূপে
আবিষ্কৃত হয় ১৭৪৮ সালে।
পালাঙ্কি
মায়ান সভ্যতা হচ্ছে পৃথিবীর আরেক বিখ্যাত ও
রহস্যময় সভ্যতা। মায়ানদের একটি বিখ্যাত শহর ছিল এই পালাঙ্কি শহর।
মেক্সিকোর চিয়াপাস রাজ্যের গহীন বনে এই শহরটির অবস্থান ছিল। খ্রিস্টপূর্ব
১ম শতকে এই শহরটি নির্মাণ করা হয়। এই শহরটিতে মায়ানদের স্থাপত্যবিদ্যার
দারুন পরিচয় ফুটে ওঠে। ৭০২ সালের দিকে আরেকটি মায়ান শহর তনিনাসের শত্রুতার
কারণেই পালাঙ্কি শহরটি বিলুপ্ত হয়েছিল। ২০ শতাব্দীর শুরুর দিকে ফ্রান্স
ব্লুম নামে একজন আবিষ্কারক এই শহরটির ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পান।
No comments:
Post a Comment